বেড না থাকায় রোগীকে ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে,আর কতো কি হবে?
বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় কোভিড রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় হাসপাতালগুলোতে অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়েছে।
এধরনের বেশিরভাগ জেলায় হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় এবং বেডের সংখ্যা অনেক কম হওয়ায় গুরুতর রোগীরা ছুটছেন বিভাগীয় শহরের বড় হাসপাতালে।
কিন্তু বিভাগীয় শহরের হাসপাতালগুলোও রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।
অনেক হাসপাতালে কোভিডের জন্য নির্ধারিত বেড খালি না থাকায় অতিরিক্ত রোগীকে ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা দেয়ার খবরও পাওয়া গেছে।
চিকিৎসকরা বলেছেন, রোগীর চাপ আরও বেড়ে গেলে চিকিৎসা সেবা বড় সংকটে পড়তে পারে।
দেশের দক্ষিণে খুলনা নগরীতে কোভিড রোগীর জন্য নির্ধারিত একশো বেডের একটি হাসপাতাল করা হয়েছিল।
সেখানে চিকিৎসার কাজে রয়েছেন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা।
সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা থেকে শুরু করে বাগেরহাট পর্যন্ত এবং অন্যদিকে কুষ্টিয়া, যশোর, নড়াইল, পিরোজপুর থেকে কোভিড রোগীরা যাচ্ছেন খুলনার সেই হাসপাতালে।
ফলে ঐ হাসপাতালের পক্ষ থেকে গুরুতর নয় এমন রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
ঐ হাসপাতালের মুখপাত্র এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক সুহাশ রঞ্জন হালদার বলেছেন, গুরুতর রোগীর সংখ্যাও অনেক বেশি, সেজন্য বেড না থাকায় অনেককে ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
"আমাদের খুলনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল একশো শয্যার। কিন্তু রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় আমরা ৩০টি শয্যা বাড়িয়ে সেবা দিচ্ছিলাম। কিন্তু রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের এখন আর স্থান সংকুলান হচ্ছে না নতুন কোন বেড যুক্ত করার," বলেন মি: হালদার।
তিনি বলেছেন, "খুলনায় আমাদের হাসপাতালে স্থান সংকুলান হচ্ছে না, যার কারণে এখন আমরা ফ্লোরে রেখে রোগীর সেবা দিচ্ছি। আমাদের খুলনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে আজ (শুক্রবার) সকাল আটটা পর্যন্ত (১৩০টি শয্যার বিপরীতে) ১৪৩ জন রোগী ছিল। এ কারণে আমাদের ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।"
সুহাশ রঞ্জন হালদার উল্লেখ করেন, "কোভিড রোগীর চিকিৎসা বিশেষ ধরনের হওয়ার কারণে কখনও কখনও তাদের হাইফ্লো অক্সিজেন দেয়ার প্রয়োজন হয় বা ভেন্টিলেটার দেয়ার প্রয়োজন হয়। সেকারণে এ ধরনের রোগীদের ফ্লোরে রেখে চিকিৎসা সেবা দেয়া মোটেই সম্ভব নয়।"
উত্তর পশ্চিমের সীমান্তবর্তী জেলাতেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ উর্ধ্বমুখী রয়েছে।
সেই অঞ্চলের বিভাগীয় শহর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালেও প্রতিদিনই রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
গত একদিনেই ঐ হাসপাতালে কোভিড রোগীদের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
রাজশাহী মহানগরীতে সংক্রমণ বাড়ছে, সেই চাপ তো রয়েছেই।
আশেপাশের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর ছাড়াও পাবনা থেকেও কোভিড রোগী চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন রাজশাহীর ঐ হাসপাতালে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেছেন, তারা এখনও রোগীর চাপ সামলাতে পারছেন।
"আমাদের হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনসহ বেড আছে ২৭১টা। এর বাইরে অক্সেজেন কনসেনট্রেটর দিয়ে ১৮৩টা বেড লাগাতে পারবো। আর আমাদের আইসিইউ বেড আছে ১৮টা। সেগুলোতে রোগী আছে," বলেন মি: ইয়াজদানী।
তিনি আরও বলেন, "আইসিইউ যাদের লাগছে, তাদের সবাইকে দিতে পারছি না। কিন্তু যাদের অক্সিজেন বেশি দরকার হচ্ছে, হাইফ্লো নেজাল ক্যানালা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি।"
বড় জেলার বড় হাসপাতালগুলোতে সংখ্যায় কম হলেও আইসিইউ আছে। কিন্তু বেশিরভাগ জেলার হাসপাতালে আইসিইউ নেই।
এসব হাসপাতালে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হলেও তা সীমিত বলে স্থানীয় চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই দফায় মোট ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন দেয়ার পর সংক্রমণ উর্ধ্বমুখী রয়েছে।
এই জেলার বিএমএ'র সাধারণ সম্পাদক এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ বা স্বাচিব-এর জেলা সভাপতি ডা: গোলাম রাব্বানী বলেছেন, চাপাইনবাবগঞ্জে সদর হাসপাতালে শয্যার অভাবে অনেক রোগী ভর্তি হতে পারছেন না।
"আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ হাসপাতালে ১৮ বেড থেকে বাড়িয়ে ৩০ বেড করেছিলাম। এখন ৫০ বেডের করোনা ইউনিট। এই ৫০ বেডই সব সময় ভরা থাকছে। কখনও কখনও বেডের চেয়ে অতিরিক্ত রোগীও থাকছে। তারপরও রোগী ভর্তি হওয়ার জন্য চাপ থাকছে।"
ডা: রাব্বানী আরও বলেছেন, "অনেক রোগী ভর্তি হওয়ার সুযোগও পাচ্ছে না। সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৫০ বেড থেকে বাড়িয়ে ১০০ বেড করতে বলেছে।"
তবে তিনি উল্লেখ করেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাসপাতালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মী সংকট বড় উদ্বেগ তৈরি করছে। সেজন্য শুধু বেড বাড়িয়েই ভাল চিকিসা সেবা পাওয়া যাবে না বলে তিনি মনে করেন।
"চাঁপাইনবাবগঞ্জ হাসপাতালে সত্যি কথা বললে চিকিৎসক সংকট রয়েছে। এখানে চারজন নতুন চিকিৎসক দেয়া হয়েছে। তারা কাজে যোগ দিলে চিকিৎসকের সংখ্যা ২০ জন হবে। কিন্তু এই চিকিৎসক দিয়ে করোনা ইউনিটে সেবা দেয়া দুরহ ব্যাপার," বলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডা: রাব্বানী।
নওগাঁ, নাটোরসহ আরও কয়েকটি জেলা থেকেও চিকিৎসার একই চিত্র পাওয়া গেছে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেছেন, রোগীর সংখ্যা যে বাড়ছে, সেই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর হাসপাতালে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
"আইসিইউর শয্যা সংখ্যা কোথাও আনলিমিটেড থাকা সম্ভব না বা থাকে না। কিন্তু রোগীদের দরকার অক্সিজেন। এজন্য অক্সিজেন জেনারেটর ইউনিট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে আছে। এবং পুরোনো জেলা শহরের হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করা হয়েছে," বলেন অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা।
তিনি আরও বলেছেন, "প্রত্যেকদিনই আসলে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। যেখানে শয্যা বাড়ানো প্রয়োজন, সেখানে বাড়বে। সেভাবেই চলছে এখন পর্যন্ত।"
মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকদের অনেকে বলেছেন, রোগীর চাপ আরও বাড়তে থাকলে হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট প্রকট হতে পারে।