কে এই মনসুর আব্বাস ইজরায়েলের ?

কে এই মনসুর আব্বাস ইজরায়েলের ?

ইসরায়েল

 


ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কট্টর ডানপন্থী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক যুগ ধরে ক্ষমতায়। তাঁকে ক্ষমতা থেকে হটাতে একজোট হয়েছে দেশটির বিরোধী দলগুলো। নিজেদের আদর্শগত পার্থক্য এড়িয়ে নেতানিয়াহু–বিরোধী জোট গড়তে ঐতিহাসিক চুক্তিতে পৌঁছেছেন দলগুলোর নেতারা। আগামী রোববার নতুন সরকার গঠনের প্রশ্নে ভোটাভুটিতে নেতানিয়াহুর ভাগ্য নির্ধারিত হবে।

নেতানিয়াহু–বিরোধী এ জোটে আলোচিত নাম মনসুর আব্বাস। তিনি ইসরায়েলে বসবাসরত আরব-ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড আরব লিস্টের (ইউএএল) নেতা। ইসরায়েলের সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনে তাঁর দল চারটি আসন পেয়েছে। মনসুর আব্বাস নেতানিয়াহু–বিরোধী জোটে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর হাত ধরে ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো ফিলিস্তিনপন্থী রাজনৈতিক দল ইসরায়েলের সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ শরিকের ভূমিকা পালন করছে।


যদিও ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন—দুই জায়গাতেই মনসুর আব্বাসের এমন রাজনৈতিক ভূমিকা তীব্রভাবে সমালোচিত হচ্ছে। সমালোচকেরা বলছেন, নেতানিয়াহুকে হটাতে আপাত সফল হলেও ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষায় মনসুরের বড় কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবেন না। বরং এর মধ্য দিয়ে তিনি ফিলিস্তিনবিরোধী কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।


ইসরায়েলের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মনসুরকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। কে এই মনসুর আব্বাস? যিনি ফিলিস্তিনি হয়েও ইসরায়েলে সরকার গঠনে অন্যতম নির্ধারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। মনসুর আব্বাসের জন্ম ১৯৭৪ সালে, ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় মাগহার জেলায়। তিনি হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুজালেম থেকে দন্তচিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব হাইফায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবনে তিনি আরব স্টুডেন্টস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সান্নিধ্যে আসেন ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ নিমার দারউইশের। এভাবেই রাজনীতিতে প্রবেশ মনসুর আব্বাসের।

মনসুর আব্বাস ২০০৭ সালে ইউএএলের সাধারণ সম্পাদক হন। তিন বছরের মাথায় তিনি ইসলামিক মুভমেন্টের দক্ষিণাঞ্চলীয় শাখার ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে নেসেটের নির্বাচনে আরব জাতীয়তাবাদী দল বালাদের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়েন মনসুর। নির্বাচিত সদস্য হিসেবে নেসেট যান। তবে মতৈক্য না হওয়ায় এবারের নির্বাচনে এককভাবে লড়ে মনসুরের দল ইউএএল। ফলাফল চারটি আসনে বিজয়। ইউএএল মূলত ইসরায়েলের সংখ্যালঘু মুসলিম নাগরিকদের রাজনৈতিক সংগঠন। কাজেই দলটির মূল অ্যাজেন্ডা আরব-ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ সংরক্ষণ।


এমন রাজনৈতিক অবস্থান ও অ্যাজেন্ডা নিয়ে ইসরায়েলে সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়াকে ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে বিবেচনা করছে ইউএএল। এবারের নির্বাচনের পরে নেতানিয়াহুকে হটাতে ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী দল ইয়ামিনা পার্টির প্রধান নাফতালি বেনেত ও মধ্যপন্থী দল ইয়েস আদিতের নেতা ইয়ার লাপিড জোট গড়েছেন। এই জোটে যুক্ত হয়েছে মনসুর আব্বাসের ইউএএলসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তবে আগামী রোববার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা যাচাইয়ে ভোটাভুটি হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হলে আবারও নির্বাচন হবে ইসরায়েলে। আর এমনটা হলে গত দুই বছরের মধ্যে পঞ্চমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে হবে ইসরায়েলের নাগরিকদের।


মনসুর আব্বাস বরাবর বলে এসেছেন, ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের জীবনমান উন্নয়নে নেতানিয়াহুসহ ডানপন্থী রাজনীতিকদের সঙ্গে কাজ করতে তাঁর আপত্তি নেই। ভোটের আগে বালাদের সঙ্গে মতবিরোধের বড় কারণ এটি। এখন নতুন জোট সরকার গঠন করতে পারলে তিনি ফিলিস্তিনি–অধ্যুষিত ইসরায়েলি শহরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন ও অপরাধ দমনে আরও ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বরাদ্দ পাবেন বলে জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা। মনসুর আব্বাস নতুন সরকারের অধীন বসতি স্থাপনের নামে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি বেআইনিভাবে দখল ও ধ্বংস করার ইসরায়েলি পরিকল্পনা বন্ধে তৎপর থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জোট গঠনের চুক্তি সইয়ের পরে সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া এক বার্তায় ৪৭ বছর বয়সী মনসুর আব্বাস বলেছেন, ‘ইসরায়েলে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য আনতে আমরা নতুন জোটে নাম লেখাতে রাজি হয়েছি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি এটা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, আমাদের সমর্থন নিয়ে নতুন জোট সরকার গঠিত হলে, আমরা নীতি নির্ধারণে প্রভাব রাখতে পারব। এটা আরব জনগোষ্ঠীর জন্য লাভজনক হবে।’


তবে ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজীবী দিয়ানা ভুট্টু আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইসরায়েলের রাজনীতিতে কিংমেকার হবেন, এমন চিন্তা করে থাকলে বড় ভুল করছেন মনসুর আব্বাস। তিনি শুধু নতুন জোট গঠনে সহায়ক হবেন। তবে ফিলিস্তিনি হিসেবে এটা আমাদের কাজ নয়। আমরা ওই শাসনকাঠামোর বিরোধীপক্ষ। আমাদের ভূমিকা হওয়া উচিত নিজেদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করা।’ দিয়ানার মতে, নেতানিয়াহু–বিরোধী জোট সরকার গড়তে পারলেও সেখান থেকে মনসুর ও তাঁর দলের অর্জন হবে সামান্যই।

এই জোটে মনসুরের যোগ দেওয়া ভালো চোখে দেখছে না সাধারণ ফিলিস্তিনিরাও। এ বিষয়ে দিয়ানা ভুট্টু বলেন, ‘ফিলিস্তিনের মানুষ মনসুরের নতুন জোটে যোগ দেওয়া সমর্থন করছে না।’ গত ১০ মে থেকে টানা ১১ দিনের ইসরায়েলি বিমান হামলায় আড়াই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়। গাজা ভূখণ্ডে শত শত বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়েছে এ হামলায়।


ইসরায়েলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আইনি লড়াই চালান জাফর ফারাহ। তিনি স্থানীয় অধিকার সংগঠন মোসাওয়া সেন্টারের পরিচালক। আল–জাজিরাকে জাফর বলেন, নতুন জোট থেকে মনসুর আব্বাস ইসরায়েলি আরবদের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ নিতে হয়তো সক্ষম হবেন। তবে নেতানিয়াহু নিজেই এসব খাতে বরাদ্দের বিষয়ে রাজি ছিলেন। এটা নতুন কোনো অর্জন হবে না।


জাফর ফারাহ আরও বলেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের দখলদারি ও কাঠামোগত আগ্রাসনের তুলনায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন খাতে বেশি মনোযোগ মনসুরের। এটা প্রমাণ করে, ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে।

এসব সমালোচনার জবাবে ইউএএলের সেক্রেটারি জেনারেল ইব্রাহিম হিজাজি বলেছেন, ‘আরব দলগুলো বরাবরই শাসনকাঠামোর প্রভাববলয়ের বাইরে রয়েছে। আমরা শাসনকাঠামোর অংশ হয়ে আবাসন, অপরাধ ও সহিংসতা দমনের মতো বিষয় নিয়ে সরাসরি কাজ করতে পারব। যা ইসরায়েলের আগের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে আরব-ফিলিস্তিনিদের সুবিধা দেবে।’


আরব জাতীয়তাবাদী বালাদ পার্টির নেতা সামি আবু শেহাদে বলেন, মনসুর আব্বাস এমন একটি সরকারে যুক্ত হতে যাচ্ছেন, যেটা ইসরায়েলের ভেতরে-বাইরে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের বিরুদ্ধে সদা সক্রিয়। এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ফিলিস্তিনিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন।

নতুন জোটের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত একসময় নেতানিয়াহু সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন। ফলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসনের দায় এ কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক এড়াতে পারেন না। এ বিষয় সামনে এনে ইসরায়েলের আরব দলগুলোর জোট জয়েন্ট লিস্টের সদস্য সামি আবু শেহাদে রয়টার্সকে বলেন, কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মনসুর আব্বাস ঐতিহাসিক রাজনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তন এনেছেন। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সক্রিয় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এটা বড় অপরাধ।

Ads on article

Advertise in articles 1

advertising articles 2

Advertise under the article